শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নায়করাজ রাজ্জাকের শেষ বিদায়

সর্বস্তরের মানুষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানালো বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক, শক্তিমান অভিনেতা এবং পরিচালক-প্রযোজক নায়করাজ রাজ্জাককে।কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার নাগরিক শ্রদ্ধানুষ্ঠানে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণসহ সমাজের নানা পেশার মানুষের ঢল নামে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ভক্ত-শুভাকাঙ্খি, রাজধানী ও আশেপাশের এলাকা থেকে আগত নারী-পুরুষের ফুলেল শ্রদ্ধায় সিক্ত হন এই মহানায়ক। নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সেখানে তার স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। খোলা হয় শোক বই।
সেখান থেকে গুলশান আজাদ মসজিদে দুপুর তিনটায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। এর আগে সকাল ১১টায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তার প্রিয় স্থান, দীর্ঘ ৫০ বছরের কর্মক্ষেত্র বিএফডিসিতে। সেখানে চলচ্চিত্রাঙ্গনের শিল্পী, কলাকুশলী, পরিচালক ও প্রযোজকবৃন্দ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এফডিসিতেই তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
৭৫ বছর বয়সী বাঙালীর প্রিয় এ অভিনেতা বেশ কিছুদিন ধরে নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। কার্ডিয়াক এ্যাটাক হলে তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে ইন্তেকাল করেন।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে বানিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, নায়করাজ রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তার চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের চলচ্চিত্রের। এ শূন্যস্থান কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ঢাকাই চলচ্চিত্রের উত্তম কুমার ছিলেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫ দশক দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে একাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে টেনে নিয়ে যাওয়া এ অভিনেতাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি মন্ত্রীআসাদুজ্জাসান নূর ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও নায়ক রাজ্জাকের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম খান, পরিচালক গাজী মাজহারুল আনোয়ার, নায়ক উজ্জ্বলসহ আরো অনেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, রাজ্জাকের মতো সংস্কৃতিমনা মানুষ চলচ্চিত্রঙ্গনে খুব কম দেখেছি। সারা জীবন তিনি সংগ্রামী চেতনা ধারণ করে গেছেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের চলচ্চিত্র যাত্রায় তার সাথে অনেক স্মৃতি রয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য আমরা তার মতো একজন গুণী শিল্পীর সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম। এই মহানায়ককে একনজর দেখতে ও শ্রদ্ধা জানাতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ এবং রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে গৃহিনী ও শিশুসহ নানা বয়সী মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছুটে আসেন। নারী-পুরুষের পৃথক দু’টি লাইন মরদেহের বেদী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেইট পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। সবার হাতে ছিল লাল গোলাপসহ নানা ফুল।
শরীয়তপুর থেকে আজ সকালে ঢাকায় এসেছেন ৫৫ বছর বয়সী ওয়ার্কসপ মিস্ত্রী ফজর আলী। তিনি বাসস’কে জানান, নায়ক রাজ্জাককে একনজর দেখতে ও শ্রদ্ধা জানাতেই তার ঢাকায় আগমন। রাজ্জাকের অধিকাংশ চলচ্চিত্র তিনি দেখেছেন উল্লেখ করে বলেন, তার মতো এতো ভাল অভিনেতা আমাদের দেশে আর জন্মাবে কিনা তার জানা নেই। ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা কেরানীগঞ্জ থেকে সরকারী চাকরিজীবী শামসুল হক নায়করাজকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন শহীদ মিনারে। তিনি জানান, রাজ্জাকের ‘রংবাজ’ ছবি দেখার পর থেকেই তিনি তার ভক্ত হয়ে যান। তার এমন কোন ছবি নেই যা, তিনি দেখেননি বলেও জানান। রাজধানীর কলতাবাজার থেকে এসেছেন গৃহিনী রওশন আরা বেগম। তিনি বাসস’কে জানান, রাজ্জাক আমাদের চলচ্চিত্রের মহানায়ক। তার অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই তার মহাপ্রস্থানে আমি তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি।
ঢাকা নাসিং কলেজের ১০ জন ছাত্রী এসেছেন তাদের নায়ককে শেষ বিদায় জানাতে। তাদের মধ্যে মুন্নী সরকার ও সুজা বিশ্বাস বাসসকে জানান, নায়ক রাজ্জাকের অভিনয় ছিল খুবই জীবন্ত। তিনি আমাদের মহানায়ক। ‘বাবা কেন চাকর’; ‘স্বার্থপর’ ইত্যাদি ছবিতে রাজ্জাকের অভিনয় তাদের হৃদয়ে দাগ কেঁটে গেছে বলেও তারা জানান।শহীদ মিনারে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ টেলিভিশন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এ্যান্ড কলেজ, অডিও ভিজুয়াল টেকনিক্যাল ওনার্স এসোসিয়েশন (এভিটোয়া) আবাহনী ক্রীড়াচক্র ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এ শক্তিমান অভিনেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়।
বিএফডিসিতে শ্রদ্ধা নিবেদন
বিএফডিসির প্রধান ফটক থেকে শুরু করে ভেতরের পুরো চত্বর ছিল লোকে লোকারণ্য। সকাল থেকে শুরু হওয়া মুসলধারে বৃষ্টির পর রৌদ্রের প্রচন্ড প্রখরতাও দমিয়ে রাখতে পারেনি নায়করাজের ভক্তদের। চলচ্চিত্রাঙ্গনের ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি উৎসুক মানুষের ভিড়ে পুরো এলাকায় তিল ধারনের জায়গা ছিলনা। সবাই প্রিয় অভিনেতা, প্রিয় মানুষ, নায়করাজ রাজ্জাককে এক নজর দেখার জন্য যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সবার মুখে বিষন্নতার ছাপ। অনেকে কেঁদে ফেলেন। পুরো এলাকাজুড়ে পুলিশি নিরাপত্তা বেষ্টনি। অনেকে প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে না পেরে বাইরে অবস্থান নেয়।
বেলা ১১টার দিকে প্রয়াত নায়কের মরদেহ বহনকারী গাড়ী এসে পৌঁছায় এফডিসিতে। সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত রাজ্জাকের বড় ছেলে চিত্রনায়ক বাপ্পা রাজ ও সম্রাট। সেখানে গাড়ীর খোলা দরজার ফাক দিয়েই এক নজর দেখা এবং একে একে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। এখানে তথ্য মন্ত্রনালয়, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার, সিনেম্যাক্স মুভি পরিবার, বাংলাদেশ আওয়ামী সাংস্কৃতিক লীগ, বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব, চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থা, চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি, সিনে স্থির চিত্রগ্রাহক সমিতি, জাসাসসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। অন্যান্যের মধ্যে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার, অভিনেতা আলমগীর, চিত্রনায়িকা ববিতা, শাবনূর, নায়ক শাকিব খান, অবিনেতা সুব্রত, আলীরাজ, রুবেল, ফেরদৌস, আহম্মদ শরিফ, ওমর সানি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি অভিনেতা মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক নায়ক জায়েদ খানসহ শ্রদ্ধা জানান।
এখানে প্রথম নামাজে জানাজায় শরিক হন শিল্পী কলা-কুশলিরা। জানাজার আগে রাজ্জাকের বড় ছেলে বাপ্পারাজ বলেন, আমার আব্বা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। তার আত্মা যেন শান্তিতে থাকে।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনের পথিকৃৎ রাজ্জাক ভাইয়ের অবদান ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে ভেবেছেন। আমরা সরকারিভাবে তার এই কর্মকান্ডকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করব। যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তার থেকে শিক্ষা নিতে পারে। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।ববিতা বলেন, হঠাৎ এই সংবাদটা শোনার পর কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার সঙ্গে অনেক ছবিতে জুটিবদ্ধ হয়ে কাজ করেছি। সব স্মৃতি ভেসে উঠছে একে একে। আমি কিছুতেই মানতে পারছি না নায়করাজ আর নেই। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
আলমগীর বলেন, আমার বলার কিছুই নাই। পিতা হারালে সন্তানের যেমন লাগে আমারও তেমন লাগছে।শাকিব খান বলেন, এখনকার প্রজন্ম এবং আগামী যত প্রজন্ম আসবে তাদের কাছে নায়ক রাজ রাজ্জাক প্রেরণা হয়ে থাকবেন। আমরা একজন আইডল হারালাম। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।ওমর সানী বলেন, নায়ক রাজ রাজ্জাককে আমরা অনেক অবেলায় হারালাম। তার আরো অনেক কিছু দেয়ার ছিলো চলচ্চিত্রকে। তরুণ প্রজন্মের আইডল হিসেবে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন।

Contact

Location:

67/A Pioneer Road, Kakrail Dhaka.

Call:

01711945949

Loading
Your message has been sent. Thank you!